Search This Blog

আগামী দিনের বিনোদন ত্রিমাত্রিক বিনোদন।

Tuesday, August 16, 2011

খুব বেশি দিন হয়নি হাই ডেফিনিশন টেলিভিশন বাজারে ছড়িয়ে পড়েছে। ঝকঝকে সচ্ছ ছবির প্রতিশ্রুতি নিয়ে আসা এল সি ডি অথবা প্লাজমা টিভিও বেশি দিনের প্রচলন নয়। তবে প্রযুক্তির গতিতে এরই মধ্যে পুরনো হতে বসেছে এই সব ভিউয়িং সিস্টেম। বাজারে এসে গেছে থ্রিডি টিভি। মাতিয়ে তুলেছে চারদিক। সবার মনে এখন একটা প্রশ্ন; কি এই থ্রিডি প্রযুক্তি। কেন এটা এত আলোড়ন তুলেছে সারা পৃথিবীতে, এমনকি বাংলাদেশেও এর কথা শোনা যায় এখানে সেখানে।

আমরা দুচোখে যা দেখি তার দৈর্ঘ্য প্রস্থ ও গভীরতা আমরা বুঝতে পারি। আমাদের অবস্থান থেকে তার দুরত্ব বুঝতে পারি। বুঝতে পারি কারণ এগুলো আমরা দেখি স্টেরিওস্কোপিক ভিশন ব্যবস্থায়। আমরা যেহেতু তিনটি মাত্রাকে একই সাথে দেখতে পাই, তাই একে থ্রিডি ভিশনও বলা হয়। এতদিন আমরা টিভিতে যা দেখেছি তা দ্বিমাত্রিক। কেবলমাত্র দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও আলোছায়াকে ব্যবহার করে তৈরি করা এক ধরনের বিভ্রমের মাধ্যমে আমাদের কিছুটা ত্রিমাত্রিক অনুভুতি দেবার চেষ্টা করা হয়। আমরা টিভিতে একটি বস্তুর কিছুটা ত্রিমাত্রিক অবস্থা বুঝতে পারি, কিন্তু তা কিছুতেই বাস্তব দেখার অনুভুতি এনে দেয় না আমাদের কাছে। কিন্তু বর্তমানের থ্রিডি টেকনোলজি এই অনুভুতি এনে দিতে পারে আপনাকে।

থ্রিডি টেকনোলজি যে হঠাৎ করে উড়ে এসেছ তা কিন্তু নয়। এ নিয়ে গবেষনা হয়ে আসছে অনেক দিন থেকেই। বাংলাদেশেও এর আগমন একবারে নতুন নয়। বছর কয়েক আগে থ্রিডি থিয়েটার নামে একটি বিনোদন ব্যবস্থা চালু করার চেষ্টা করেছিল একটি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান। কিন্তু একঘেয়ে কনটেন্ট ও উচ্চ মুল্যের কারনে তারা সেটাকে তেমন জনপ্রিয় করতে পারেনি। যারা সেখানে থ্রিডি দর্শনের অভিজ্ঞতা নিয়েছেন, তাদের একটি বিশেষ চশমা পড়তে হয়েছিল। বেশ বড় টেলিভিশন সেট ব্যবহার করা হয়েছিল সেখানে। টিভির উপরে একটি ইনফ্রারেড ট্রান্সমিটার ছিল যা বিশেষ সিগনাল পাঠিয়ে চশমাকে ব্যবহার যোগ্য করে তোলে। সংক্ষেপে এই হল থ্রিডি ব্যবস্থা।

থ্রিডি ব্যবস্থার মূল ভিত্তি হচ্ছে স্টেরিওস্কোপিক ভিউয়িং সিস্টেম। আমরা দু চোখের মাধ্যমে দেখি বলে আমাদের কাছ থেকে বস্তুর দুরত্ব ও তার আকার বুঝতে পারি। একই দৃশ্য দুটো সামান্য ভিন্ন অ্যাঙ্গেল থেকে দেখা হয় বলে আমরা এটা বুঝতে পারি। ভিউয়িং ব্যবস্থা নিয়ে গবেষনা করতে গিয়ে গবেষকরা দেখলেন, যদি কোন দৃশ্যকে দুটি ভিন্ন আঙ্গেল থেকে রেকর্ড করা যায় এবং সামান্য ভিন্ন অবস্থান থেকে তা দেখান যায়, তা হলে কৃত্রিম ব্যবস্থাতেও ত্রিমাত্রিক ছবি দেখানো সম্ভব। স্টেরিওস্কোপিক ভিউয়িং এর মুল মন্ত্রটিও তাই। মনে করুন, একটি দৃশ্য ধারণ করা হয়েছে জোড়া ক্যামেরায়, যেখানে ক্যামেরার লেন্সদুটির অবস্থান পাশাপাশি আনুভুমিক ভাবে, ঠিক যেভাবে মানুষের চোখের অবস্থান। দুটি ভিন্ন ছবি সামান্য ভিন্ন অবস্থান থেকে তোলা হয়েছে। এখন ছবি দুটি যদি সমান দুরত্ব থেকে পাশাপাশি দেখাবার ব্যবস্থা করানো যায়, তবে যে ছবি দেখবে তার মনে হবে সে কোন সত্যি দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে আছে। কারন, সে সাধারণ ভাবে যা দেখে, ছবিতেও সেভাবেই দেখতে পাচ্ছে। অনেকেই ছোটবেলায় একটি মজার যন্ত্র নিয়ে খেলা করেছেন। এর নাম স্টেরিওস্কোপ। দুটি যুক্ত আইপিস এর সামনে একটি কাগজের চাকতি বসাবার ব্যবস্থা থাকতো যার মধ্যে পজিটিভ ফিল্ম এ ছবি গোলাকার অবস্থানে বসান থাকতো। অনেকগুলো ছবি এমন ভাবে বসানো থাকতো যে বাম পাশের ছবিটির ঠিক সরাসরি ডান পাশে একই ছবির ভিন্ন অ্যাঙ্গেলের ছবি থাকতো। একটি ছোট বাটন থাকতো চাকতি ঘুরিয়ে ছবি পরিবর্তন করা যেত। যে ছবিই সিলেক্ট করা হত, সেটির ডানপাশের ও বামপাশের ছবি একই সাথে ডান ও বাম আইপিসে দেখা যেত।


সাধারণভাবে এটিই ত্রিমাত্রিক ছবি দেখার পদ্ধতি হিসেবে চলে এসেছে অনেক বছর ধরে। চলমান ছবি দেখার প্রশ্ন যখন এলো, তখন আর এ প্রযুক্তি দিয়ে কাজ হল না। তখন নতুন কোন প্রযুক্তির দরকার হয়ে পড়ল। আবিস্কার হল বাই কালার গ্লাস এর। যদিও বাই কালার গ্লাস এর প্রচলন আগেও ছিল, তবে চলমান ছবি দেখার ক্রেজ আসার আগে এর তেমন জনপ্রিয়তা ছিল না।। এ ব্যবস্থায় কালার ফিল্ম এ একই সাথে দুটি ভিন্ন ছবি লাল ও সায়ান ভার্সনে ভিন্ন ভিন্ন ভাবে তুলে একই ফিল্ম এ সুপার ইমম্পোজ করে বসিয়ে দেয়া হত। সেই ছবি কেউ সাধারণ ভাবে দেখলে তার মনে হবে লাল ও নীল রং এর ছবি একটা অপরটার উপরে বেখাপ্পাভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। তবে ছবিটা যদি বিশেষ চশমা দিয়ে দেখা যায়, যেটার একটা লেন্স লাল ও অপরটি সায়ান বা নীল, তখন দৃশ্যটি উদ্ভট লাগবে না বরং ত্রিমাত্রিক মনে হবে। বর্তমানে অবশ্য এই পদ্ধতি আর ব্যবহার করা হয়না। এখন বিশেষ ইলেকট্রনিক চশমা ব্যবহার করা হয়, যেটা থ্রিডি ব্যবস্থার সাথে ইন্টারঅ্যাকটিভ ভাবে কাজ করে।

একে বলা হয় অ্যাকটিভ থ্রিডি সিস্টেম। আমরা জানি টিভি মনিটর নির্দিষ্ট বিরতিতে স্ক্রীন রিফ্রেশ করে থাকে। এর মান সাধারণত হয় ৬০ বার প্রতি সেকেন্ড। এই ব্যবস্থায় দুটি ভিন্ন অ্যাঙ্গেলের ছবিকে একই ফ্রেমে বন্দি করা হয়। তবে তারা রিফ্রেশ রেট দ্বারা আলাদা করা থাকে। বেজোড় রিফ্রেশরেট গুলো বাম চোখের জন্যে এবং জোড় রিফেশরেট গুলো ডান চোখের জন্যে। সাধারণ ভাবে দেখলে মনে হবে সিগনালের সমস্যার জন্যে ভিডিও কাপা কাপা আসছে। একে ঠিক ভাবে থ্রিডি দেখতে চাইলে যে বিশেষ থ্রিডি গ্লাস ব্যবহার করতে হবে তাকে বলে শাটারগ্লাস থ্রিডি চশমা। এই চশমায় বিশেষ লিকুইড ক্রিস্টাল ব্যবহার করা হয় যেগুলো সিগনাল পেলে যেকোন অংশকে কালো বা অসচ্ছ করে দিতে পারে। যখন টিভিতে এক চোখের জন্যে ভিডিও দেখানো হচ্ছে, তখন আরেক চোখ যেন তা দেখতে না পায় সেজন্যে টিভির সাথে লাগানো বিশেষ ট্রান্সমিটার থেকে পাওয়া সিগনাল অনুযায়ী কখনও বাম পাশের গ্লাস কখনও ডান পাশের গ্লাস বন্ধ বা অসচ্ছ থাকছে। ফলে ব্যবহারকারী দুচোখে দুটি ভিন্ন অ্যাঙ্গেলের তবে একই ছবি দেখতে পারেন যেটি তাকে ত্রিমাত্রিক দর্শনের ব্যবস্থা করে দেয়। বিশেষ চশমার গ্লাস খোলা থাকা বা বন্ধ থাকা এতই কম সময়ের মধ্যে ঘটে যে মানুষের চোখের পক্ষে তার পার্থক্য করা সম্ভব নয়।

বর্তমান সময়ের বেশিরভাগ থ্রিডি ভিউয়িং সিস্টেম এই ভাবেই কাজ করে থাকে। বিশেস করে সনি ও স্যামসং এর মত জায়ান্টরা তাদের থ্রিডি টেকনোলজি টিভিগুলোতে এই সিস্টেম এ যার যার নিজস্ব পদ্ধতিতে ব্যবহার করছে। তবে বিশেষ টিভি সেট করে আর বিশেষ চশমা চোখে লাগিয়েই যেন ভেবে বসবেন না যে আপনি থ্রিডি দেখতে পারবেন। আপরি যা দেখবেন সেই কনটেন্টকেও থ্রিডি কনটেন্ট হতে হবে। বাস্তব দৃশ্য হলে বিশেষ থ্রিডি ক্যামেরায় তাকে ধারণ করতে হবে, নয়ত এই ব্যবস্থা কাজ করবে না। বিশ্বকাপ ফুটবল উপলক্ষে ইউ এস এর কয়েকটি টিভি চ্যানেল খেলাগুলো তাদের ভিউয়ার দের জন্যে থ্রিডি আকারে প্রচার করেছিল, সামনের বিশ্বকাপ ক্রিকেটেও এই ব্যবস্থা তারা করবে কিনা সেটা দেখবার বিষয়। যার মানে হল, এখন কেবল থ্রিডি টিভি ও থ্রিডি চশমা থাকলে বিশ্বকাপ অনেকটা খেলার মাঠের আমেজেই দেখা যাবে।

কম্পিউটারে থ্রিডি দেখা যাবে কি? অনেকেই এই প্রশ্নটি করেছেন, কম্পিউটার মনিটরে থ্রিডি দেখা যাবে কিনা। একটি সাধারণ কম্পিউটার মনিটরে থ্রিডি দেখার জন্যে যে ব্যবস্থা দরকার ছিল তা এত দিন বাজারে ছিল না। কিন্তু সম্প্রতি এনভিডিয়া বাজারে নিয়ে এসেছে তাদের বিশেষ থ্রিডি গ্রাফিক্স প্রসেসর যেটা কিনা কম্পিউটার মনিটরে থ্রিডি দেখাতে সক্ষম। এর জন্যে অবশ্যই বিশেষ থ্রিডি গ্লাস দরকার হবে। এখানে অ্যাকটিভ শাটার গ্লাস পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছে। যার মানে হল এই বিশেষ গ্রাফিক্স কার্ড একই সাথে একটি ভিডিও অথবা ছবির দুটি করে ফ্রেম তৈরি করবে। এই তৈরি করা ফ্রেম দুটি একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্য মনিটরে, যার রিফ্রেশ রেট প্রতি সেকেন্ড এ ১২০ বার, দেখানো হবে একই সাথে। আগেই জানানো হয়েছে, এই শাটার গ্লাস পদ্ধতিতে ছবির দুটি ফ্রেমকে একই সাথে দেখানো হবে । তবে তাদের রিফ্রেশ রেটের পার্থক্য থাকবে। যার মানে, যখন একটি ছবি ডান চোখের জন্যে দেখানো হবে,যার রিফ্রেশ রেটি হবে সেকেন্ড এ ৬০ বার, তখন বাম চোখের গ্লাসটি অস্বচ্ছ হয়ে যাবে। এর ফলাফল একটি ছবি কেবল এক চোখেই ধরা পড়বে। আবার পর মুহুর্তেই একই ঘটনা ঘটবে অন্য চোখের জন্যে। এভাবে একটি মনিটর ব্যবহার করে তার রিফ্রেশ রেটকে দুভাগ করে প্রায় একই সময়ে দুটি ছবি দেখিয়ে থ্রিডি এফেক্ট আনা হবে। এনভিডিয়া কার্ডটির সাথে একটি বিশেষ সফটয়্যার দিয়েছে যা ব্যবহার করে বাজারে থাকা প্রায় তিনশ গেম থ্রিডি পরিবেশে খেলা যাবে। তবে এর বাজার দামও প্রায় আকাশ ছোয়া। একটি গ্রাফিক্স সিস্টেম এর জন্যে আড়াই তিন লক্ষ টাকা খরচ করাটা সত্যিই দুঃসাধ্য ব্যাপার। তবে আর সব জিনিসের মতই, সময়ের সাথে সাথে এরও দাম হাতের নাগালে চ্যেল আসবে নিঃসন্দেহে। তবে কবে নামবে, সেটাই গবেষনার বিষয়।

তবে এই কি সব? না, এর পাশাপাশি আরও কিছু কাজ হচ্ছে থ্রিডির জগতে। কয়েকটি কোম্পানী চেষ্টা করে চলেছে এমন টিভি বানাবার যেগুলো দিয়ে চশমা ছাড়াই থ্রিডি দেখা যাবে। এর পাশাপাশি একটি প্রচলিত আবার নতুন, এরকম একটি পদ্ধতি হচ্ছে হেড মাউন্টেড ডিসপ্লে নিয়েও কাজ চলছে জোরেসোরে।। এটাও অনেকটা চশমার মতই দেখতে, কিন্তু এর মাঝে দুচোখের জন্যে কৌশলে দুটি উচ্চ রেজুলেশন এর এলসিডি স্ক্রিন বসিয়ে দেয়া হয়েছে। যার ফলে দুটি ভিন্ন ভিডিও স্ট্রিম ব্যবহার করে অনায়াসেই থ্রিডি ভিডিও দেখানো যাচ্ছে। বিশেষ লেন্স ব্যবহারের ফলে ছোট স্ক্রিনে দেখলেও ব্যবহারকারীর মনে হবে তিনি ৫০” বা ৮০“ স্ক্রিনে সবকিছু দেখছেন। তবে এই প্রযুক্তিকে নিয়ে সাধারণ থ্রিডি বাদেও আরও উন্নত সম্ভাবনা আছে। গবেষকরা এখন সেটাকে নিয়েই কাজ করে চলেছেন।

প্রথমে সাদাকালো টেলিভিশন, তারপর রঙ্গিন টেলিভিশন, এখন চলছে থ্রিডি টেলিভিশন এর কাল। কে জানে কি অপেক্ষা করছে দুর কিংবা অদুর ভবিষ্যতে। যে গতিতে উন্নয়ন চলছে, কে জানে, থ্রিডি পরবর্তী প্রযুক্তির সাথেও দেখা হয়ে যেতে পারে এই জীবদ্দশাতেই! সেটাকি হলোগ্রাফিক টেলিভিশন? কে জানে!…

তবে অপেক্ষা করে দেখা যেতেই পারে।

0 comments:

Post a Comment