গরিবের কম্পিউটার: আই স্লেট, বদলে কি দেবে শিক্ষা ব্যবস্থা?

আই স্লেট: সুবিধা বন্চিত শিশুদের শিক্ষার নতুন হাতিয়ার হতে পারে এটা।
কম্পিউটার তথা তথ্যপ্রযুক্তি নিয়ে চারদিকে যত কথাই হোক না কেন, একটা কথা বিশেষজ্ঞরা সবসময়ই বলেন, আর তা হচ্ছে, আম জনতার মধ্যে তথ্যপ্রযুক্তিকে ছড়িয়ে দিতে না পারলে এ প্রযুক্তির হাজারও উন্নতিতেও কোনো লাভ হবে না। কারণ তখনও কম্পিউটার এলিট শ্রেণীর মধ্যে সীমাবদ্ধ একটি পণ্য হিসেবেই রয়ে যাবে। এটি বিবেচিত হবে একটি বিলাস দ্রব্য হিসেবে, আর ক্ষুধার্ত মানুষ যে বিলাস দ্রব্য নিয়ে মাথা ঘামায় না সেটিতো বলাই বাহুল্য। আমাদের দেশে কী দেখা যায়? যখন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য প্রচন্ড বেড়ে যায় তখন কম্পিউটারের বাজারে ভীড় কমে যায়। আবার যখন নিত্যপণ্যের মূল্য কমে যায় তখন কম্পিউটার তথা তথ্যপ্রযুক্তির বাজারও চাঙ্গা হয়ে ওঠে। আর এ কারণেই কম্পিউটারকে বিলাস দ্রব্যের তকমা থেকে মুক্ত করে গণ মানুষের পণ্যে পরিণত করার জন্য চেষ্টার কমতি নেই। এরই অংশ হিসেবে ওয়ান ল্যাপটপ পার চাইল্ড বা একশে ডলারের ল্যাপটপসহ আরো অনেক গণমুখী প্রযুক্তি উদ্যোগ বিভিন্ন সময় নেয়া হয়েছে, এখনও হচ্ছে। এরকমই একটি উদ্যোগ আই-স্লেট।
উদ্দেশ্য সেই একই। কম্পিউটারকে একেবারে তৃণমূল মানুষের নাগালের মধ্যে নিয়ে যাওয়া। আই-স্লেট কী? অল্প কথায়, এটি হচ্ছে সৌরশক্তিচালিত এবং টাচস্ক্রিন প্রযুক্তিসমৃদ্ধ একটি প্রযুক্তি যেটি তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে শ্রেণীকক্ষে ব্যবহার করা হবে। সম্প্রতি নিউ ইয়র্কে ইনস্টিটিউট অব ইলেকট্রিক্যাল এন্ড ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারস-এর ১২৫তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে আই-স্লেট উদ্যোগটির কথা প্রথম ঘোষণা করা হয়। বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তানসহ উপমহাদেশের গ্রামীণ অঞ্চলে একেবারে নিচের দিকের ক্লাসে লক্ষ লক্ষ শিশু এখনও স্লেট নিয়ে স্কুলে যায়। তাদের প্রথম অক্ষর পরিচয়ই হয় কালো রঙের স্লেটে সাদা চক দিয়ে লেখার মাধ্যমে। আই-স্লেট উদ্যোগের পেছনে যারা আছেন তারা চাচ্ছেন শিশুদের হাতের স্লেটের পরিবর্তে সে জায়গা দখল করুক এলইডি স্ক্রিন, যেটি দেখতে হবে প্রথাগত স্লেটের মতই।
যদি এ ধরনের এলইডি স্ক্রিনকে কোটি কোটি শিশুর হাতে তুলে দেয়া যায় তাহলে তারা খুব দক্ষ কোনো শিক্ষকের প্রয়োজন ছাড়াই নিজেরা নিজেরা পড়ালেখার কাজকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবে। শুনতে অবিশ্বাস্য মনে হলেও উদ্যোক্তারা এ উদ্যোগের ভবিষ্যৎ নিয়ে খুবই আশাবাদী। এ আশাবাদী মানুষগুলোর একেবারে প্রথম সারিতে আছেন ড. কৃষ্ণ পালেম নামে এক বিজ্ঞানী। ভারতীয় বংশোদ্ভুত এই বিজ্ঞানী বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাইস ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষকতায় রত আছেন। সেখানে তিনি ও তাঁর সহকর্মীরা মিলে আই-স্লেট নামের এই মহতী উদ্যোগকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন সামনের দিকে।
আই-স্লেট পরিকল্পনার কেন্দ্রবিন্দুতে আছে প্রোবাবিলিস্টিক চিপ নামে পরিচিত এক ধরনের কম্পিউটার চিপ। এই কম্পিউটার চিপটিও তৈরি করেছেন ড. পালেম ও তাঁর সহকর্মীরা। পারফরমেন্সের দিক দিয়ে অন্যান্য কম্পিউটার চিপের চাইতে এটি পিছিয়ে আছে অনেকটাই, কিন্তু সেই ঘাটতি এটি পুষিয়ে নিয়েছে এনার্জি বা শক্তি ব্যবহারে দারুন মিতব্যয়ীতার পরিচয় দিয়ে। একটি স্ট্যান্ডার্ড কম্পিউটার চিপের চাইতে এই প্রোবাবিলিস্টিক চিপ ৩০ ভাগের এক ভাগ শক্তি ব্যবহার করে।

ড. কৃষ্ন পালেম
ড. পালেমের হিসাবটা সহজ। ভারত বা বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের একটি শিশুর বিশাল পারফরমেন্স সমৃদ্ধ কোনো কম্পিউটারের প্রয়োজন নেই, কিন্তু তার প্রয়োজন সামর্থ্যরে মধ্যে দামে একটি কম্পিউটার। আই-স্লেট অয়্যারলেস নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে কোর্সওয়ার্কসহ পাঠ্যবস্তু ডাউনলোড করে নিতে পারবে। আর বর্তমানে বিভিন্ন কম্পিউটারে ব্যবহৃত প্রসেসরগুলোর চাইতে ড. পালেমের আবি®কৃত এ চিপ অনেক অনেক কম দামী। ফলে উন্নয়নশীল বিশ্বের দরিদ্র শিশুদের জন্য আধুনিক প্রসেসরের চাইতে ড. পালেমের প্রোবাবিলিস্টিক চিপ সমৃদ্ধ প্রসেসর হবে অনেক সহজলভ্য। ড. পালেম মনে করেন, উপযুক্ত উদ্যোগ নিলে তাঁর এই চিপ কেবল কম্পিউটারই নয়, অন্যান্য ইলেকট্রনিক গ্যাজেট যেমন মোবাইল ফোন এবং টেলিভিশনেও জায়গা করে নিতে পারবে। সেক্ষেত্রে মোবাইল ফোনে একবার চার্জ দিলে কয়েক সপ্তাহ আর চার্জ না দিলেও চলবে। আর টেলিভিশনগুলো বর্তমান টেলিভিশনের চাইতে অনেক কম বিদ্যুতে চলবে, কিন্তু ছবির মান কমবে না এতটুকুও।
এ বছরই নিজ দেশ ভারতে আই-স্লেট এর পরীক্ষামূলক প্রয়োগ শুরু করতে চান ড. পালেম। ড. পালেমের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন মানবতাবাদী একদল সমাজকর্মী। তাঁরা ভারতের শিশুদের হাত থেকে চক আর স্লেট সরিয়ে নিয়ে সে জায়গায় তুলে দিতে চাইছেন আই-স্লেট নামের এই এলইডি স্ক্রিনটি।
আগেই বলেছি, আই-স্লেট এর মস্তিস্ক হিসেবে কাজ করবে এর বিশেষভাবে নির্মিত চিপ যেটি ‘প্রোবাবিলিস্টিক যুক্তি’ ব্যবহার করে হিসাব নিকাশ করে। মোবাইল ফোন বা কম্পিউটারে ব্যবহৃত অন্যান্য চিপ তৈরি হয় কমপ্লিমেন্টারি মেটাল অক্সাইড সমিকন্ডাক্টর টেকনোলজি ব্যবহার করে, কিন্তু আই-স্লেট ব্যবহার করে প্রোবাবিলিস্টিক কমপ্লিমেন্টারি মেটাল অক্সাইড সেমিকন্ডাক্টর। আই-স্লেট এর স্ক্রিনে শক্তি জোগানো এবং ছোট স্ক্রিনে স্ট্রিমিং ভিডিও চালানোই হবে এর প্রধান কাজ। এই চিপ হিসাব নিকাশের ফলাফল একেবারে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে না দিয়ে মোটামুটিভাবে দেয়।
আর এ কারণেই এ চিপের পারফরমেন্স অন্যান্য কম্পিউটার চিপের চাইতে দুর্বল। অন্যান্য চিপ একেবারে নিখুঁতভাবে হিসাব নিকাশ করার প্রয়োজনে বুলিয়ান লজিক ব্যবহার করলেও প্রোবাবিলিস্টিক চিপ তা করবে না। তাই বলে এ চিপকে অলসও বলা যাবে না। কাজ করার জন্য ঠিক যতটুকু প্রয়োজন এটি ততটাই নিখুঁত হবার চেষ্টা করে। ‘সবচেয়ে বেশি নিখুঁত’ নয়। এখানেই এর সঙ্গে অন্যান্য কম্পিউটার চিপের পার্থক্য। এ মুহূর্তে ড. পালেম কাজ করছেন ভিজুয়াল বেজড গণিত পাঠক্রম তৈরি করার জন্য, যেটি ছাত্রছাত্রীদের ভার্চুয়াল শিক্ষকেরও ভূমিকা পালন করবে। ভারতের দক্ষিণাঞ্চলে পরিচালিত তাঁদের পাইলট প্রজেক্টটি সাফল্যমন্ডিত হলে ভবিষ্যতে আমাদের দেশেও ড. পালেমের চমৎকার এই প্রযুক্তি গ্রামাঞ্চলের হাজার হাজার শিশুর হাতে তুলে দিতে পারে দরিদ্রদের এই কম্পিউটার!
0 comments:
Post a Comment